চিংড়ি, রোগজীবাণু ও পরিবেশগত পীড়নের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ায় চিংড়ির শরীরে সৃষ্ট অস্বাভাবিক অবস্থাকে রোগ বলা হয়। পুকুরের জলজ পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে চিংড়ির রোগবালাই সৃষ্টি হয়। এসব রোগের ধরন, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু সমূহের প্রজাতি, প্রকৃতি ও আক্রমণের ধারা অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই রোগের লক্ষণও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রকৃতি অনুযায়ী চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা কারণ সমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) ব্যাকটেরিয়া (খ) ভাইরাস, (গ) ছত্রাক, ও (ঘ) পরজীবী।
ব্যাকটেরিয়া খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুবীক্ষণিক জীব। এদের শরীরের ব্যাস সাধারণত ০.০০১ মিমি এর মতো হয়ে থাকে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে এদের দেখা যায় না। জলে, স্থলে, বাতাসে সর্বত্রই এরা বিদ্যমান। চিংড়ির পেশীকোষে সাধারণত প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। তবে এদের গায়ে, পায়ে, ফুলকা ও খাদ্যনালীতে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এসব ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চিংড়ির দেহে বিভিন্ন প্রকার রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নবর্ণিত ব্যাকটেরিয়াসমূহ চিংড়িতে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
১. ভিব্রিও ব্যাকটেরিয়া এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া চিংড়ির রক্তে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয় । ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে চিংড়ি মারা যায়।
২. সিউডোমেনাস ব্যাকটেরিয়া এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ফলে চিংড়ির দেহের রং পরিবর্তিত হয়।
৩. কাইটিনাভেরাস ব্যাকটেরিয়া: এরা চিংড়ির খোলস ও ক্যারাপেসকে আক্রান্ত করে। এদের আক্রমণের ফলে চিংড়ির খোলসে অসংখ্য কালো কালো দাগ দেখা যায়।
৪. ফিলামেন্টাস ব্যাকটেরিয়া: চিংড়ির উদর, খোলস, শিরোবক্ষ ও পুচ্ছ পাখনা (Telson) অঞ্চলে এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমন করে থাকে। ফুলকা আক্রমন হলে চিংড়ির শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটে ফলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: এককোষী অনুজীবদের একটি বিরাট জগৎ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া আণুবীক্ষনিক জীব যা খালি চোখে দেখা যায় না। চিংড়ির দেহে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এই ব্যাকটেরিয়া চরম ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টি করে। রোগ সৃষ্টিকারী প্রধান ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিসমূহ হলোঃ Vibrio parahaemolyticus, Vibrio harveyi, Vibrio vulnificus, V. damsela, Aeromonas spp., Flavobacterium spp, Vibrio alginolyticus প্রভৃতি। গলদা চিংড়িতে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ গুলো হলোঃ Filamentous bacterial disease, Necrotising Hepatopancreatitis (NHP), Mycobacteriosis, Chitinolytic bacterial shell disease, Rickettsial infection প্রভৃতি।
ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ভাইরাস আকারে অনেক ছোট। ভাইরাস সাধারণত ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। বাংলাদেশে মাঝে মাছে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। সাধারণত চীনা "ভাইরাস" এবং সিস্টেমিক এক্টোডারমাল ও মেসাডোরমাল ব্যাকিউলা ভাইরাস সংক্ষেপে সাদা ভাইরাস নামে পরিচিত। এরা চিংড়ির গায়ে সাদা দাগের সৃষ্টি করে। এছাড়া মনোডন ব্যাকিউলো ভাইরাস ও ই-টাইপ ব্যাকিউলা ভাইরাস এর কারণেও চিংড়িতে ভাইরাস রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নমানের খাদ্য প্রয়োগ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দূষিত মাটি ইত্যাদির কারণে ভাইরাসজনিত রোগ ছড়াতে পারে। এই রোগের ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকা, লেজের অংশ অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। অনেক সময় কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ভাইরাস আক্রমণের ফলে ব্যাপক হারে চিংড়ি মারা যেতে থাকে।
ভাইরাসজনিত রোগ: ভাইরাস এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈবকণা বা অনুজীব যা জীবিত কোষের ভিতরে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। চিংড়ি চাষের সমস্যাগুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। চিংড়ি চাষে ভাইরাসের আক্রমনে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং আমাদের দেশে ভাইরাসের কারনে চিংড়ির ব্যাপক মহামারী দেখা যায়। চিংড়ির ক্ষেত্রে প্রধান ভাইরাস জনিত রোগ গুলো হলোঃ White Spot Syndrome Virus (WSSV), Yellow head virus (YHV), Baculovirus penaei (BP), Monodon Baculovirus (MBV), Infectious Myonecrosis Virus (IMNV), Hepatopancreatic Parvovirus (HPV) ।
সাধারণত ফুসেরিয়ান, স্যাপ্রোলোনিয়া, লেজিনিডিয়াম, হেলিপস ও সাইলেপিডিয়াম নামক ছত্রাক দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ছত্রাক সাধারণত চিংড়ির ফুলকায় আক্রমণ করে থাকে। ফলে চিংড়ি শ্বাসকষ্টে মারা যায়।
ছত্রাকজনিত রোগ: ছত্রাক প্রধানত চিংড়ির লার্ভা পর্যায়ে বেশি আক্রমন করে। এছাড়া সাধারণত চিংড়ির ফুলকাতেও আক্রমন করে। ছত্রাক সাধারণত চিংড়ির ফুলকাতে আক্রমন করে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে। যার ফলে চিংড়ি মারা যায়। প্রধান সংক্রামক প্রজাতিগুলো গুলোঃ Lagenidium callinectes, L. marina Sirolpidium spp. Pythium spp. Fusarium solani, Fusarium incarnatum প্রভৃতি।
বিভিন্ন প্রকার পরজীবী চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে থাকে। এসব পরজীবী চিংড়ির খোলস, ফুলকা ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে থাকে। এসকল পরজীবী এককোষী বা বহুকোষী হয়ে থাকে। বহুকোষী পরজীবীর মধ্যে ট্রিমাটোডা (trematode) নেমাটাডা (nematode) সিস্টোভা (cestode) জাতীয় কৃমি দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
চিংড়িতে প্রোক্রিসটোনেলা (Prochristonelia), প্যারাক্রিটোনেলা (Parachristonelia) এবং রেনিবুলবাস পিনাইর (Renibulbus Penacl) ধরনের সিস্টোড বা ফিতাকৃমি দেখা যায়। এছাড়া চিংড়িতে তিন ধরনের উকুন (Shrimp fluke) দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে অপারকলিডি (Opercolidae), মাইক্রোফলিডি (Microphollidae) ও একিনোস্টোমাটিভাস (Echinostomatidas)। এককোষী প্রোটোজোয়া দ্বারাও চিংড়ি আক্রান্ত হয়। এক্টোকমেনসেল প্রোটোজোয়া, প্রোটোজোয়া কমেনসেলস, এপোস্টোম সিলিয়েট, গ্রেগারিন, মাইক্রোন্তোরিডিয়া প্রভৃতি এককোষী প্রাণী দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
পরজীবীঘটিত রোগ; বিভিন্ন প্রকার এককোষী ও বহুকোষী পরজীবী আছে যারা চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে। এই পরজীবীগুলো চিংড়ির ত্বকের সাথে লেগে থেকে ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফুলকাতে আক্রমণ করে, চিংড়ির ওজন কমিয়ে দেয় এবং অবশেষে মৃত্যু ঘটায়। Block/ Brown gill disease হয়ে থাকে Zoothamnium, Epistylis, Vorticella প্রোটোজোয়ার জন্য, Gregarine disease হয়ে থাকে অ্যানিলিড পরজীবী Nematopsis spp. এর জন্য এবং Cotton shrimp এর জন্য দায়ী Agmasoma sp.
এছাড়াও পরিবেশ দূষণ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে পারে। নিচে চিংড়ির রোগর কারণসমূহ ও রোগ সৃষ্টির বিভিন্ন উপাদানের বর্ণনা দেওয়া হলো।
রোগের কারণ | রোগ সৃষ্টির অন্তর্নিহিত উপাদান |
---|---|
ক) সংক্রমন | ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস ছত্রাক পরজীবী |
খ) পরিবেশ দুষণ | অক্সিজেনের অভাব মাত্রা অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া মাত্রা অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি জৈব তলানী হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন হঠাৎ লবণাক্ততার পরিবর্তন কীটনাশকের ব্যবহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের আধিক্য |
গ) পুষ্টিহীনতা | প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব সুষম খাদ্যের অভাব অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ |
ঘ) ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি | পোনা বা জুভেনাইল উৎপাদনে ত্রুটি আহত বা ক্ষতযুক্ত পোনা পরিবহন জনিত পিড়ন বা ত্রুটি পোনা প্রতিপালনে ত্রুটি পুকুর প্রস্তুতিতে ত্রুটি। |
গলদা চিংড়ির চাষে এবং বাণিজ্যিকভাবে সফলতা অর্জনের জন্য চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ির রোগ প্রতিকার বা চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। তাই চিংড়ির রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই উত্তম। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমেও রোগবালাই এর আক্রমণ থেকে চিংড়িকে রক্ষা করা সম্ভব। সাধারণত সম্ভাব্য রোগবালাই হতে চিংড়িকে রক্ষা করার জন্য পূর্বাহ্নেই যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলা হয়। রোগবালাই প্রাদুর্ভাবের কারণসমূহ বিশেষণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।